বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
গাজীপুরের কাশিমপুর নয়াপাড়ায় মাল্টি ফ্যাবস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে গত সোমবার ১৩ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা দেশের পোশাক খাতকে আবারও আন্তর্জাতিক চাপে ফেলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, এই ঘটনাকে ইস্যু হিসেবে কাজে লাগাতে পারে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সংস্কার কার্যক্রমে এগিয়ে আসা দুটি আন্তর্জাতিক জোট সংগঠন। এ দুটি হলো ইউরোপের ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি বাংলাদেশ ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি (অ্যালায়েন্স)।
ত্রুটিপূর্ণ বয়লার বিস্ফোরণে শ্রমিকের মৃত্যুর খবরে উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো। তারা পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত বয়লারগুলো নিবিড় পরিদর্শনের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে। গাজীপুরে বয়লার বিস্ফোরণে প্রাণহানির প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক বয়কটের আহ্বানও জানিয়েছেন পশ্চিমা অধিকারকর্মীরা।
বাংলাদেশের পোশাক খাতে সংস্কারকাজ ইউরোপীয় ও আমেরিকার ক্রেতা জোটের তদারকির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালের মে মাসে। কিন্তু এর আগেই জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সরকারকে না জানিয়ে অ্যাকর্ড ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রি অল গ্লোবাল ও গ্লোবাল ইউনিয়ন চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম আরো তিন বছর পরিচালনার জন্য। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে ওই চুক্তি স্বাক্ষরের ঘটনায় খুশি হননি বাংলাদেশের পোশাক খাতের মালিকরা। এ অবস্থায় বৈশ্বিক ক্রেতা ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
তবে বয়লার দুর্ঘটনায় ১৩ শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনায় ক্রেতাগোষ্ঠী ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এ দেশের সরকার ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে মাল্টি ফ্যাবসের মতো বিশ্বমানের একটি কারখানায় মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার ব্যবহার এবং এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা তাদের নজরদারির দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করবে।
কারখানায় ব্যবহৃত বয়লার পরিদর্শন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারি সংস্থা প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের। সংস্থাটির সীমাবদ্ধতার কথা অকপটে স্বীকার করেন এর কর্মকর্তারাই। উপপ্রধান বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, মাত্র ছয়জন পরিদর্শক দিয়ে ১০ হাজার নিবন্ধিত বয়লার পরিদর্শন করা প্রায় অসম্ভব। তিনি জানান, ভারতের কেবল কলকাতায়ই রয়েছে ২৫০ জন বয়লার পরিদর্শক।
কারখানা নিয়মিত পরিদর্শন করে বয়লারের মান নিয়ন্ত্রণ করার মতো উপযুক্ত জনবল ও সামর্থ্য নেই প্রতিষ্ঠানটির। ফলে অগ্নি নিরাপত্তা ও ভবন অবকাঠামো ত্রুটিমুক্ত থাকলেও মাল্টি ফ্যাবস কারখানার বয়লার ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।
প্রধান বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মাল্টিফ্যাবস লিমিটেডে বিস্ফোরিত বয়লারটি ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। জার্মানির অমনিকল ব্র্যান্ডের বয়লারটির মেয়াদ গত ২৪ জুন শেষ হয়। মেয়াদ শেষের আট দিন পরও বয়লারটি সচল করার চেষ্টা করছিল কারখানা কর্তৃপক্ষ। সচল করার চেষ্টার শুরুতেই কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় অপারেটরদের। প্রেসার লিমিট সুইচ বা যে চাবির মাধ্যমে চাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয় তা উপেক্ষা করেই বয়লার সচল করার চেষ্টার একপর্যায়ে এটি বিস্ফোরিত হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বয়লার বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ নির্ধারিত মাত্রার বেশি চাপে এটি পরিচালনা করা। ধারণা করছি, গত সোমবারের বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনাটিও একই ভুলের কারণে ঘটেছে। দেশে বয়লার পরিচালনায় কারিগরি দক্ষতারও ঘাটতি আছে। দক্ষ অপারেটর থাকলেও সামান্য অসচেতনতায় বয়লার বিস্ফোরিত হতে পারে। ’
আব্দুল মান্নান জানান, শুধু গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবসসহ গত এক বছরে বয়লার দুর্ঘটনায় মোট ৩৪ জন প্রাণ হারিয়েছে। গত এপ্রিলে দিনাজপুরে একটি চালকলে বয়লার বিস্ফোরণে ২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জে একজন ও মাল্টিফ্যাবসে গত সোমবার নিহত হয়েছে ১৩ জন।
শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিলসের তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে কর্মক্ষেত্রে ৩৩টি বয়লার দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছে ৪১ জন এবং আহত হয়েছে ২৩৭ জন।
বয়লারের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ কে জানতে চাইলে আব্দুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশ বয়লার রেগুলেশন (বিবিআর) প্রণয়নের পর থেকে দেশেই তৈরি হয় বয়লার। বর্তমানে ৫০ শতাংশ বয়লার স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়। আর এসব বয়লারের মান তদারকির দায়িত্ব প্রধান বয়লার পরিদর্শক অধিদপ্তরের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনা ফায়ার সার্ভিসের লোক এসকর্ট করলেও বিষয়টি পুরোপুরি তদারকি করে প্রধান বয়লার অধিদপ্তরের কার্যালয়। মাল্টিফ্যাবস কারখানায় দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বয়লার সংযোজনের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখার নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। ওই কারখানায় তা মানা হয়নি। দেখা গেছে, মূল কারখানা ভবনেই তারা বয়লার স্থাপন করেছে। আর এভাবে অপরিকল্পিতভাবে বয়লার স্থাপনের ফলে এমন দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর অগ্নি ও কারখানা নিরাপত্তায় আমরা যে প্রশংসা অর্জন করেছিলাম এই বয়লার দুর্ঘটনার ফলে তা আবারও ম্লান হলো। পরিচালনায় অবহেলা, অবসাবধানতা ও অদক্ষতার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ’
বয়লারের নিরাপত্তা রক্ষার এ সীমাবদ্ধতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইন্ডাস্ট্রি অল গ্লোবাল ইউনিয়ন। আন্তর্জাতিক এই শ্রম সংগঠন এক বিবৃতিতে বলেছে, এ বিস্ফোরণ প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাতে বয়লারের নিরাপত্তায় অনেক গলদ রয়েছে। অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তার জন্য অ্যাকর্ডের নজরদারিতে থাকা মাল্টিফ্যাবস কারখানাটি অ্যাকর্ডের প্রকৌশলীরা পরিদর্শন করলেও বয়লারের নিরাপত্তার বিষয়টি চুক্তিতে ছিল না। এ দুর্ঘটনা প্রমাণ করেছে কারখানার সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য এ দেশে অ্যাকর্ডের আরো কাজ করা দরকার।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরাম এক বিবৃতিতে বলেছে, অ্যাকর্ডের সেফটি স্ট্যান্ডার্ডে অবশ্যই বয়লার নিরাপত্তা সংযুক্ত করতে হবে।
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘অ্যাকর্ড সম্প্রতি ক্রেতা ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আরো তিন বছর থাকার চুক্তি করেছে। এ চুক্তি মোটেই প্রক্রিয়া অনুযায়ী হয়নি। বয়লার দুর্ঘটনা তাদের এ দেশে সময় বৃদ্ধির ব্যাপারে আমাদের কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘বিদেশি ক্রেতারা সরকারের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যেভাবে থাকতে চাইছে, এটা ঠিক নয়। তবে ওরা থাকলে আমাদের জন্য বিষয়টি মন্দ হয় না। বয়লার দুর্ঘটনার কারণে আমাদের কর্তৃপক্ষকে বিদেশিদের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগের পথ আরো সহজ হলো। তবে প্রত্যাশা, সরকারের সব প্রক্রিয়া মেনেই অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্স বাংলাদেশে কাজ করবে। ’কালের কণ্ঠ