শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > আন্তর্জাতিক তিন ক্রেডিট রেটিং সংস্থার প্রতিবেদন ॥ চার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক তিন ক্রেডিট রেটিং সংস্থার প্রতিবেদন ॥ চার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের চারটি ঝুঁকি চলছে। এ ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স, মুডি’স এবং ফিচ রেটিংসের প্রতিবেদনে। সংস্থাগুলোর মতে, রাজনৈতিক ঝুঁকি, শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা, ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকিং খাত- এ চারটি দুর্বলতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা। তবে এসব বাধা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে তারা। বাংলাদেশের সার্বভৌম ঋণমান ঝুঁকি নিয়ে গত আগস্টে প্রকাশিত সংস্থাগুলোর পৃথক পৃথক রেটিংস ও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো হয়েছে।
ফিচ রেটিংস তাদের প্রতিবেদন পৃথকভাবে উল্লেখ করেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অহিংসতার মাঝারি ধরনের ঋণাত্মক প্রভাব থাকলেও তা অর্থনীতিকে পঙ্গু করেনি। ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি বলেছে, গত জানুয়ারির নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ থাকার পরও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত রয়েছে।
আর স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স-এর প্রতিবেদনে উচ্চ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এবং দাতা সংস্থাগুলোর শক্তিশালী প্রতিশ্রুতির পরও অর্থনীতির ঝুঁকি হিসেবে নিম্ন আয়ের অর্থনীতি, রাজস্ব খাতের সীমাবদ্ধতা এবং অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে যে ধরনের স্থিতিশীলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেটি কত দিন টিকে থাকবে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে ক্রেডিট রেটিংস সংস্থাগুলো। জানুয়ারির নির্বাচনসহ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ রাজনৈতিক ঝুঁকি দীর্ঘমেয়াদে বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করছে ফিচ রেটিংস। তারা বলছে, একমুখী রাজনীতি এবং এসব নিয়ে অস্থিরতা অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ব্যাংকিং খাতে বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে দুর্নীতি, ঋণ কেলেঙ্কারি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাবকেও অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি মনে করছে সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে তারা বলছে, ২০১৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে শ্রেণিকৃত (খেলাপি) ঋণের পরিমাণ আগের প্রান্তিকের ৮ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৩ শতাংশ।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স এবং ফিচ রেটিংস-এ বাংলাদেশকে ‘বি বি মাইনাস’ রেটিং দিয়েছে। আর মুডি’স-এর রেটিংয়ে বাংলাদেশের অর্জন ‘বি এ ৩’। জানা গেছে, বাংলাদেশ যে রেটিং অর্জন করেছে তাতে নিম্ন মাঝারি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় দেশের নিচে অবস্থান হয়েছে। এ ধরনের গ্রেডে তালিকাভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অনেকটা অনুমাননির্ভর, যেখানে টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ, অভ্যন্তরীণ চাহিদা, মাথাপিছু আয় ইত্যাদির ওপর।
রেটিং সংস্থাগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ঝুঁকি নিরূপণের পাশাপাশি বেশ কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের প্রধান শক্তি হিসেবে স্থিতিশীল প্রকৃত দেশজ উৎপাদন (বিগত পাঁচ বছর ধরে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে জিডিপি অর্জন), শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সময়মতো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের রেকর্ড এবং জনসংখ্যার লভ্যাংশকে চিহ্নিত করেছে ফিচ রেটিংস। বাংলাদেশের বহিঃখাতের আয় বিশেষ করে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে মুডি’স। বহিঃখাত নিয়ে একই ধরনের সন্তোষ প্রকাশ করলেও স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স বলেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ যে রেটিংয়ে (বিবি-মাইনাস) অবস্থান করছে, এ রেটিং আরও উন্নত করতে চাইলে মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে।
সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশের এই দুর্বল রেটিংয়ের পেছনে মাথাপিছু নিম্ন আয়, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ছাড়াও সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি এবং জাতিসংঘের মানবসূচক উন্নয়নে নিম্ন রেটিংয়ের বিষয়গুলো কাজ করে থাকে। বি বি বা মাঝারি রেটিং অর্জনের জন্য যেখানে মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলারের উপরে লাগে, সেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৩ ডলার (২০১৩)। বাজেট ঘাটতি বা সরকারের ঋণও এ ধরনের রেটিং অর্জনে প্রভাব ফেলে। চলতি বাজেটে সরকারের ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ করে ধরা হয়েছে। অথচ মাঝারি গ্রেডে রেটিং উন্নীত করতে চাইলে বাজেট ঘাটতি ২ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিংস সংস্থাগুলো সর্বশেষ যে রেটিংস দিয়েছে এর আগেও একই রেটিংসে ছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এ বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা কমলেও রেটিংয়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটি নিয়ে উদ্যোক্তাদের মনে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। ফলে বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে যে ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ঘটছে তাতেও আর্থিক বিশৃঙ্খলার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাত সমস্যায় পড়লে সেটি শিল্প-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোতেও রয়েছে সুশাসনের অভাব। এসব দুর্বলতা না কাটাতে পারলে টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। প্রসঙ্গত, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স, মুডি’স এবং ফিচ রেটিংসের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সার্বভৌম ঋণ মান নিরূপণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আর্থিক ঝুঁকি নির্ণয় করে থাকে। চলতি বছরে বাংলাদেশের ঋণ মান নিরূপণের জন্য উল্লিখিত তিন সংস্থাকে সরকারের অনুমোদনে দায়িত্ব দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
– বাংলাদেশ প্রতিদিন