বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফার ফলাফলে আওয়ামী লীগ হতাশ। বিএনপির জন্য স্বস্তি নিয়ে এসেছে এই নির্বাচন। ফল হতাশ করলেও আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, এটা সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা নয়। একটা জায়গায় আওয়ামী লীগের অভিন্ন বিশ্লেষণ, তা হচ্ছে- অনৈক্য ও বিদ্রোহ না হলে নির্বাচনী ফল আরও তৃপ্তিদায়ক হতো।
ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত একাধিক প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে বিএনপি ও তার মিত্ররা গরিষ্ঠতা পেয়েছে। তাদের বিশ্বাস ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। এজন্য পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোয় ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী দেয়ার ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হবে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ স্বীকার করেন, বিএনপি ও তাদের মিত্ররা প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে ভালো করেছে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ একক প্রার্থী দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। একাধিক প্রার্থী থাকায় অনেক স্থানে অনেক কম ভোট পেয়েও বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা জয়ী হয়েছেন।
জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ নেই : জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি যুগান্তরকে বলেন, এটা নির্দলীয় নির্বাচন হওয়ায় প্রার্থীর জয়-পরাজয়ে ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং গোষ্ঠীগত অবস্থান বিবেচনায় আসে। তাই এ ফলাফলের ওপর রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গরিষ্ঠতা পায়নি। এর কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় বেশিরভাগ নেতাকর্মী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। অনেক স্থানে বিদ্রোহী প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তাই আওয়ামী লীগ সমর্থক ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা যে ভোট পেয়েছেন তার অনেক কম ভোট পেয়েও বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় আওয়ামী লীগ ও জাসদের পৃথক প্রার্থীর উল্লেখ করেন। সেখানে অনেক কম ভোট পেয়েও বিএনপি প্রার্থী জয়ী হয়েছেন বলে জানান।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার জন্য দলীয় অনৈক্য ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দায়ী করে দেয়া শীর্ষ দুই নেতার বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এ ব্যাপারে তার কোনো দ্বিমত নেই। আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ বিদ্রোহ। এ ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীদের নিশ্চিত বিজয় হাতছাড়া হয়েছে বা পরাজিত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেক্ষেত্রে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া ছাড়াও বহিষ্কারের খড়গ নেমে আসতে পারে বলে জানান তিনি। এজন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের সুপারিশ নেয়া হবে।
দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ফলাফল মূল্যায়নে খুব শিগগিরই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডাকবে। সেখানে জেলার সুপারিশের ভিত্তিতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন সাংগঠনিক সম্পাদকরা। তবে কবে নাগাদ এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি দলটির নেতারা।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নেতাকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে উপজেলা নির্বাচন। এই আত্মবিশ্বাসে ভর করে দল দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
বুধবারের নির্বাচনে গরিষ্ঠতা অর্জনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে দলটি। পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে বিজয়ের ব্যবধান আরও বাড়াতে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু কৌশল। সূত্র জানায়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার না করে যে কোনোভাবে সমঝোতার মাধ্যমে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। পাশাপাশি যেসব মন্ত্রী, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা বিদ্রোহীদের ইন্ধন দিচ্ছেন তাদের তালিকা করতেও বলা হয়েছে। দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করলে ওই নেতাদের ভবিষ্যতে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে না বলেও সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে।
নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন- আমরা বারবার বলে আসছি এই সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র না গিয়ে এবং বুধবারের উপজেলা নির্বাচনে ভোট দিয়ে তারা সেটা প্রমাণ করেছেন। নির্বাচনের আগে ও পরে ক্ষমতাসীনরা সারা দেশে যে হত্যা, গুম, নির্যাতন চালিয়েছে- এমনকি এখনও চালাচ্ছে জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ জানিয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, যদি কেন্দ্র দখল, সন্ত্রাস, ভয়-ভীতি না থাকত এবং সবাই ভোট দিতে পারত তবে ৯৫ ভাগ মানুষ এই সরকারকে না বলে দিত।
এই বিজয়ে দলের নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বাড়বে কিনা জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, নিঃসন্দেহে, নেতাকর্মীরা শুধু চাঙ্গাই হবেন না তাদের মাঝে ঐক্য আরও সুদৃঢ় হবে।
সূত্র জানায়, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলনের পর প্রত্যাশিত সফলতা না পাওয়ায় হতাশার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের মনোবলও ভেঙে যায়। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা এবং গ্রেফতারের ফলে সাংগঠনিকভাবে দলটি দুর্বল হয়ে পড়ে। বারবার ঘোষণা দেয়ার পরও সাংগঠনিকভাবে দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারছিল না। নেতাকর্মীদের আÍবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার অংশ হিসেবেই বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়। প্রথম দিনের ফলাফলেই প্রমাণিত হয়েছে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
সূত্রমতে, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা নানা শংকায় ছিলেন। ক্ষমতাসীনরা প্রভাব খাটিয়ে বেশিরভাগ উপজেলায় বিজয় ছিনিয়ে নেবে। নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা এবং নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারে এই আশংকা আরও প্রবল হয়ে উঠে। বুধবার নির্বাচনের প্রথম প্রহরে বেশ কয়েকটি উপজেলায় আওয়ামী লীগ তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে কেন্দ্র দখলের খবরে কেন্দ্রীয় নেতারা চিন্তিত হয়ে পড়েন। ক্ষমতাসীনরা জোর করে তাদের সম্ভাব্য জয় ছিনিয়ে নিলে পরবর্তী নির্বাচন বয়কট করার ব্যাপারেও আলোচনা হয়। কিন্ত নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর তাদের সেই আশংকা দূর হয়।
কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনী মনিটরিং সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, সরকারের নানা বাধা উপেক্ষা করেও সাধারণ মানুষ যেভাবে বিএনপির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে তা অতুলনীয়। তাদের এই সমর্থন নেতাকর্মীদের মাঝে নতুন উদ্দীপনা তৈরি করবে। যেসব নেতাকর্মী নানা কারণে হতাশ ও মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল তারা আবারও মনোবল ফিরে পাবে। যার প্রভাব বাকি উপজেলা নির্বাচনেও পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সূত্র জানায়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠে রাখার পেছনে সাবেক এমপি, মন্ত্রী এবং ওইসব এলাকার কেন্দ্রীয় নেতাদের ইন্ধন রয়েছে। এছাড়া ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাতকারী কিছু নেতাও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হন। বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে অনেক উপজেলায় নিশ্চিত বিজয় হাতছাড়া হওয়ার আশংকা করেছিলেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। বুধবার প্রথম দফা নির্বাচনে সেটা প্রমাণিতও হয়েছে। বরিশালে দুটি উপজেলায় হারার পেছনে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকাকেই মূল কারণ বলে মনে করছেন ওই এলাকার নেতাকর্মীরা। বাকেরগঞ্জ ও গৌরনদীতে সাবেক দুই এমপি বিদ্রোহীদের নির্বাচনী মাঠে রাখতে ইন্ধন জুগিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একই কারণে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে দল সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হন। এমনকি বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত বগুড়ায়ও একটি উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করে।
সূত্র জানায়, বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার কারণে অন্তত দশটি উপজেলায় নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়েছে। পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে দলটি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে কিভাবে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করা যায় তার কিছু কৌশলও নিয়েছে তারা। কৌশলের অংশ হিসেবে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। ইতিমধ্যে যারা বহিষ্কার হয়েছেন দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার শর্তে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যারা বহিষ্কৃত তাদের বহিষ্কার আদেশ তুলে নিতে কেন্দ্রীয় দফতরে আবেদন করতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন তাদের আবেদনপত্র দফতরে জমা দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কারের ফলে তৃণমূলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই আর বহিষ্কার না করে বিদ্রোহীদের পেছনে যেসব সাবেক মন্ত্রী, এমপি কিংবা কেন্দ্রীয় নেতারা ইন্ধন দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওইসব নেতাদের চিহ্নিত করে দ্রুত একটি তালিকা দিতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে খালেদা জিয়া সতর্ক করে দিয়েছেন। দলের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করলে ওইসব নেতাদের বহিষ্কারও কিংবা ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে না বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন জেলা পর্যায়ের নেতা ও নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। কেন্দ্রীয় নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীকে ইন্ধন দেয়ার পাশাপাশি দল সমর্থিত প্রার্থীকে পরাজিত করতে প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন। তৃণমূল নেতাদের এমন অভিযোগ শোনার পর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া। কয়েক দিন আগে তৃণমূলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নওগাঁর সাবেক এমপি আখতার হামিদ সিদ্দিকী তার অনুসারী একজনকে দলীয় সমর্থন নিশ্চিত করতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। খালেদা জিয়া তাকে বলেন, এক শর্তে আপনার লোককে দলীয় সমর্থন দিতে পারি। যদি ওই প্রার্থী ফেল করে তবে সামনে আপনি সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন চাইবেন না এমন শর্তে রাজি হলে তাকে দলীয় সমর্থন দেয়া হবে। আখতার হামিদ সেই শর্তে রাজি হন।যুগান্তর।