বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
বিভিন্ন অর্জনে আওয়ামী লীগের দেয়া সংবর্ধনা দেশের মানুষকে উৎসর্গ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্ণিল আয়োজনে গতকাল রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে প্রধানমন্ত্রীকে এ সংবর্ধনা দেয় আওয়ামী লীগ। সংবর্ধনায় অভিনন্দন বার্তা পাঠের পর বক্তব্য রাখেন শেখ হাসিনা। শুরুতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’। জনগণ কতটুকু পেলো সেটাই আমার কাছে সব থেকে বিবেচ্য বিষয়। এর বাইরে আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
আমার সংবর্ধনার প্রয়োজন নেই, আমি জনগণের সেবক। এই সংবর্ধনা আমি বাংলাদেশের মানুষকে উৎসর্গ করলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই, দেশের মানুষ উন্নত জীবন পাবে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলুক সেটা আমরা কখনো বরদাশত করবো না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ ইনশাআল্লাহ আমরা গড়ে তুলবো। এই এগিয়ে চলার পথ যেন আমরা অব্যাহত রাখতে পারি। শেখ হাসিনা বলেন, মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। মৃত্যুর আগে মরতে আমি রাজি না। তার আগে যতক্ষণ জীবন আছে। বাংলার মানুষের সেবা করে যাবো। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে যাবো। এতে আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে। অন্তত আমি জানি, বেহেশত থেকে তিনি দেখবেন, তার দেশের মানুষ ভালো আছে তাদের জীবনের পরিবর্তন এসেছে। আমি শুধু সেটুকুই চাই। আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। শুধু একটা জিনিসই দেখতে চাই, এই বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত, সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠেছে, যা আমার পিতার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণই আমার লক্ষ্য।
মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ, বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন, অস্ট্রেলিয়ায় গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পাওয়া এবং সর্বশেষ ভারতের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি লিট ডিগ্রি অর্জনসহ সরকারের বিভিন্ন অর্জনে অবদান রাখায় শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেয় আওয়ামী লীগ।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেয়া ১ ঘণ্টা ৩ মিনিটের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলা ও দল গোছানো এবং দেশের কল্যাণে তার দল ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিষয় তুলে ধরেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার উদ্দেশে একটি অভিনন্দনপত্র পড়ে শোনান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। পরে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় কণ্ঠশিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজের গান এবং সাদিয়া ইসলাম মৌ’র নির্দেশনায় নৃত্যনাট্য পরিবেশন করা হয়। বেলা সাড়ে ৩টার সময় অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এসময় স্লোগানে স্লোগানে তাকে স্বাগত জানান নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। রং-বেরংয়ের টুপি ও টি-শার্ট পরে এই সমাবেশে অংশ নেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ঢাকঢোল বাজিয়ে মিছিল নিয়ে আসেন অনেকে। ইংরেজি বর্ণ ‘এল’ আকৃতির বিশাল মঞ্চের সামনে ২০ হাজার চেয়ার বসানো হয়। তবে তাতে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় অনেকেই বসেন বাইরে। সংবর্ধনা মঞ্চে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ১৪ দলের শরিক নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। মৎস্য ভবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনার ভিআইপি গেইট পর্যন্ত ৪০টি তোরণ তৈরি করা হয় এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে। তোরণগুলো ছিল প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও উন্নয়নের ছবি দিয়ে সাজানো। এছাড়া উদ্যানের মঞ্চের সামনের দিকে পশ্চিমপাশে করা হয় চিত্র প্রদর্শনী। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অর্জনসহ শেখ হাসিনার অসংখ্য ছবি আঁকা ছিল।
বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে একটি মহল নৌকা ঠেকাতে নেমেছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, নৌকা কেন ঠেকাতে হবে? নৌকার অপরাধ কি? সামনে শ্রাবণ মাস। বর্ষার সময়, বন্যার সময়। নৌকা তো লাগবে। যেসব রাজনীতিকরা নৌকা ঠেকাতে নেমেছেন তাদের বন্যার সময় রিলিফ বিতরণ করতে ও চলাচল করতেও তো নৌকাই লাগবে। শেখ হাসিনা বলেন, নৌকায় ভোট দিয়েছে বলে জনগণ ভাষার অধিকার পেয়েছে। দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। দেশের উন্নয়ন হয়েছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লিখিয়েছে। পারমাণবিক ও স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে। আমার প্রশ্ন নৌকা ঠেকিয়ে কি রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় আনবেন? যারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাদের মুখে একথা মানায় না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরাই নির্বাচনে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স এনেছি। স্থানীয় ও জাতীয়সহ এ পর্যন্ত যতোগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলোতে জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। গণতন্ত্র যদি না থাকে তবে জনগণ ভোট দিয়েছে কীভাবে?
দেশের মানুষের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেবল ঘুমের সময়টুকু বাদে দিনের বাকিটা সময় তিনি কেবলই দেশের উন্নয়ন ও দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, একটা মানুষের তো ২৪ ঘণ্টা সময়। এই ২৪ ঘণ্টা থেকে আমি মাত্র ৫ ঘণ্টা নেই। আমার ঘুমানোর সময়। এছাড়া প্রতিটি মুহূর্ত আমি কাজ করি দেশের মানুষের জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্য। এর বাইরে আমার আর কোনো কাজ নেই। আমি কোনো উৎসবে যাই না। আমি কোথাও যাই না। সারাক্ষণ আমার একটাই চিন্তা, আমার দেশের উন্নয়ন, দেশের মানুষের উন্নয়ন। সারাক্ষণ চেষ্টা করি, কোথায় কোন মানুষটা কী অবস্থায় আছে, তার খোঁজখবর রাখতে।
অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে ২০২০ সালে তার জন্মশতবার্ষিকী পালনসহ ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ২০২১ সালে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করবো। জাতির পিতা বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড, ২০৪১ সালে আমরা সেই বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। ভাষণের শেষে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, শুধু একটা জিনিস দেখতে চাই, এই বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ অবশ্যই আমরা গড়ে তুলবো। এই এগিয়ে চলার পথ আমরা যেন অব্যাহত রাখতে পারি। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে-এটা আমার বিশ্বাস। কীভাবে দেশের মানুষের উন্নয়ন করা যায় সারাক্ষণ আমি এই চিন্তাই করি।
সরকারের নানা উন্নয়ন তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে আওয়ামী লীগ। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বস্তিবাসীর জন্য ঘরে ফেরা কর্মসূচি, কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক ও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু করেছে সরকার। ১৪ লাখ প্রতিবন্ধীকে ভাতা দেয়া হচ্ছে। ২ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থীর মায়ের মোবাইল ফোনে উপবৃত্তির টাকা পাঠানো হচ্ছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে। সমাজের অনগ্রসরদের বিশেষ করে হিজড়াদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ১০ টাকায় কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করেছিলেন। পরবর্তীতে আর কোনো সরকারই এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে কথা বলেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ছিটমহল চুক্তি বাস্তবায়ন করেছে। সমুদ্রসীমা সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে যে আইন করেছিলেন, ২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এসে আন্তর্জাতিক আইনে মামলা করে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করে। কিন্তু এই উদ্যোগ অন্য কোনো সরকার নেয়নি। আমরা পরমাণু চুক্তি করেছি। ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি। গোটাবিশ্বে মন্দাভাব দেখা দিলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়তে দেইনি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি আমার বাবা কত ভালোবাসতেন এদেশের মানুষকে। আমি দেখেছি, মানুষের জন্য তার হাহাকার। এই মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কত পরিকল্পনা তার ছিল। আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামকে শহর হিসেবে গড়ে তুলবো। প্রতিটি গ্রাম হবে উন্নয়নের জায়গা। প্রতিটি মানুষ পাবে নাগরিক সুবিধা। ঠিক শহরের মানুষ যে সুবিধা পায়। প্রতিটি গ্রামের মানুষ সেই সুবিধা পাবে। সেভাবেই আমরা গ্রামের মানুষের অবস্থার উন্নতি করতে চাই। শিক্ষায়-দীক্ষায় সবদিক থেকে। গ্রাম-বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে। ক্ষুধার হাহাকার থাকবে না। একটি মানুষও গৃহহারা থাকবে না। প্রত্যেকটি মানুষ উন্নত জীবন পাবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমার রাজনীতি। তিনি বলেন, আমি এক একটা কাজে যখন বাংলাদেশের সাফল্য পাই। আর আজ যা কিছু পাচ্ছি, এটা বাংলাদেশের প্রাপ্য, বাংলাদেশের জনগণের প্রাপ্য বলে মনে করি।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে এই বাংলার মাটিতে যেদিন ফিরে এসেছিলাম, আপন করে নিয়েছিল বাংলার মানুষ। এখনও মনে পড়ে। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কলকাতায় আমরা যে বাসায় ছিলাম সেখানে এক কাপড় বিক্রেতা আসতেন। তিনি আমার ও রেহানার কথা শুনে বুঝতে পারলেন আমরা বাংলাদেশি। এটি জানার পর ওই কাপড় বিক্রেতা বলেছিলেন, আপনারা কেমন জাতি? যিনি আপনাদের স্বাধীনতা এনে দিলেন সেই নেতাকেই হত্যা করলেন! আমি ও রেহানা কোনো উত্তর দিতে পারি নাই। আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে সেদিন চোখের পানি ফেলেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। অথচ এই খুনিরা দম্ভভরে বলেছিল তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের আগে বাঙালি ছিল বীরের জাতি। আর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই বাঙালি হলো খুনি জাতি। তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালে সুইডেনে আমার বোন রেহানা প্রথম জাতির পিতা হত্যার বিচার দাবি করে। ১৯৮০ সালে আমি লন্ডনে এক সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবিসহ বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবি জানাই। শেখ হাসিনা বলেন, ৭৫ পরবর্তী ক্ষমতাভোগীরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যস্ত ছিল। তারা এ দেশের মানুষের ভাগ্য বদলাতে কোনো কাজ করেনি। কিছু সুবিধাভোগীর জীবন উন্নত হয়েছে কিন্তু বাংলার মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাকে ৭৫ পরবর্তী অনেক ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করতে হয়েছে। কিন্তু পিছপা হইনি। জনগণের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে জাতির পিতার হত্যার বিচার শুরু করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করেছি। কিন্তু জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। আমি মুচলেকা দিয়ে বাংলাদেশের সম্পদ বিক্রি করে ক্ষমতায় যেতে চাই না। ২০০৮ সালে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসেছি। দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করছি। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন শুরু করে। কারণ, নির্বাচন ঠেকাতে পারলে আবার অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীরা ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু দেশের জনগণের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও ঠেকিয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে। দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে। আবার বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বিএনপি আবার মাঝপথে সেটিকে বন্ধ করে দেয়। কারণ, তারা দ্বিতীয় দফায় আবার ক্ষমতায় আসে। যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই আমাদের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে যারা প্রতিনিয়ত আমার প্রত্যেকটি কাজ সুন্দরভাবে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। সকলের সহযোগিতা না পেলে আজকে বাংলাদেশের এই এগিয়ে চলা, এটা সম্ভব হতো না। আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। তার যে উন্নত হওয়া এটা কখনো সম্ভব হতো না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ ইনশাল্লাহ আমরা গড়ে তুলবো। এই এগিয়ে চলার পথ যেন আমরা অব্যাহত রাখতে পারি।
এদিকে সমাপনী বক্তব্যে সংসদের উপনেতা ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নীল দেশে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’র সফল উৎক্ষেপণ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড এবং ভারতের আসানসোলের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। এসময় তিনি আরো বলেন, উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে নৌকার কোনো বিকল্প নেই।
এর আগে সংবর্ধনার শুরুতে পরিবেশন করা হয় জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী অতিথি মঞ্চে আসন নিলে অভ্যর্থনা সংগীতের পাশাপাশি জাতীয় ও দলীয় পতাকা নেড়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়। তাকে স্বাগত জানিয়ে ‘শেখ হাসিনা, তোমার জন্য বাংলাদেশ ধন্য’ এই শিরোনামে একটিসহ দুটি গান পরিবেশন করেন শিল্পী মমতাজ। দেশের ঐতিহ্য তুলে ধরে পরিবেশন করা হয় ‘আমার প্রিয় বাংলাদেশ’। এরপর প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে ‘রূপকাহিনীর রূপকথা’ শিরোনামে কবিতার সঙ্গে পরিবেশন করা হয় নৃত্য। দেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের দলীয় সংগীতের সঙ্গে নান্দনিক নৃত্যে সরকার প্রধানের প্রশংসায় পরিবেশন করা হয় ‘তুমি শেখ হাসিনা, তুমি অনন্য’। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হয়।
নেতাকর্মীদের ঢল: উন্নয়ন ও অর্জনে অসাধারণ সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দিতে আয়োজিত জনসমুদ্রে রূপ নেয়া সমাবেশে সকাল থেকেই নেতাকর্মীদের ঢল নামে। লাল টি-শার্ট, মাথায় সবুজ ক্যাপ, হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে উদ্যানের সবুজ চত্বর থেকে শুরু করে শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর আশপাশের এলাকায় জনতার ঢল নামে। নৌকা প্রতিকৃতি নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, নেচে-গেয়ে জনসভায় আসেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। খণ্ড খণ্ড মিছিল, ট্রাক-পিকআপ ভ্যানে চেপে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হন তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাপিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকাগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। বেলা দুটায় সংবর্ধনার মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টার পর থেকে মিছিল আসা শুরু হয়। পিকআপ নিয়ে মিছিল করে নেতাকর্মীরা ঢুকে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সকাল থেকে কোনো বাস ঢুকতে দেয়া হয়নি। কাটাবন দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সমাবেশে যেসব গাড়ি আসছে, সেগুলো পাঠিয়ে দেয়া হয় মল চত্বরে। বাংলামোটর এলাকায় ডাইভারশন দেয়ার কথা থাকলেও সকালে রাস্তায় যানজট কম থাকায় সেখানে ডাইভারশন দেয়া হয়নি। দুপুর সাড়ে ১২টার পর থেকেই সংবর্ধনাস্থলের আশপাশের প্রায় সব সড়কে ডাইভারশন দেয়া হয়। বেলা একটার পর থেকে ভিআইপি রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, পল্টন, মৎস্য ভবন এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় যানজট দেখা দেয়। শাহবাগ এলাকায় ছোট ছোট মিছিলে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড বহন করতে দেখা গেছে। এসব ব্যানারে শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে নানা অর্জনের কথা তুলে ধরা হয়। এদিকে বর্ণিল সাজসজ্জার বর্ণাঢ্য রূপ দেখা যায় সংবর্ধনাস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সুবিশাল মঞ্চ ও মাঠজুড়ে একাধিক প্যান্ডেল। দূরের দর্শনার্থীদের জন্য বসানো হয় বড় বড় ইলেক্ট্রনিক পর্দা। সারি সারি চেয়ার। উদ্যান ছাড়িয়ে আশপাশে বসানো হয় মাইক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল নজর কাড়ার মতো। পুলিশ, পুলিশের এসবি, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভেতরে-বাইরে অবস্থান নেয়। তাদের মধ্যে যথেষ্ট নারী সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। সোহওয়ার্দী উদ্যানের সবগুলো গেটে বসানো হয় আর্চওয়ে। তল্লাশি চালিয়ে নেতাকর্মীদের ভেতরে ঢোকানো হয়।
সড়কে যানজটে দুর্ভোগ: এদিকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গতকাল দুপুর থেকে বেশ কিছু সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন, টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর, রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়। পাশাপাশি বাংলামোটর, কাকরাইল চার্চ, জিরো পয়েন্ট, গোলাপশাহ মাজার, চানখাঁরপুল, বকশীবাজার, নীলক্ষেত, পলাশী, কাটাবন ক্রসিং দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়মুখী যানবাহনকে ডাইভারশন করে দেয়া হয়। ফলে বিভিন্ন সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। ট্রাফিক কর্মকর্তাদের যানজট নিরসনে হিমশিম খেতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে সময় কাটাতে হয়েছে যাত্রীদের। এদিকে গুরুত্বপূর্ণ রোকেয়া সরণি এবং খামারবাড়ি দিয়ে ফার্মগেট আসার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় পুরো এলাকার বিকল্প সড়কে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার জন্য অসুস্থ রোগীদের নিয়ে বেগ পেতে হয় তাদের স্বজনদের। অপর্যাপ্ত যানবাহন ও রাস্তা বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন অনেকে। মিরপুরের শাহানা বেগম বলেন, হঠাৎ করেই আমার স্বামী অসুস্থ হয়েছেন। সেই মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে অনেক কষ্ট করে এসেছি। কিন্তু গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। রোগী নিয়ে কীভাবে হেঁটে যাবো। শাহজানপুরের আহমেদ আলী বলেন, চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। মিছিল নিয়ে শুধু আসতেছে। কিন্তু যানবাহন চলাচল বন্ধ করে আমাদের ভোগান্তি বেড়ে গেছে। শামীমআরা নামের এক নারী বলেন, শাহবাগে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে। মিরপুর যাওয়ার কোনো কিছু পাচ্ছি না। সূত্র: মানবজমিন