বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ শহরের প্রবেশ দ্বার চাষাঢ়া থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার। এর মধ্যে ফতুল্লার শিবু মার্কেট থেকে সাইনবোর্ডের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। এ পাঁচ কিলোমিটার সড়কের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বাংলামেইলের পক্ষ থেকে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়লার ডাম্পিং হিসেবে পরিচিত এ সড়কটির এখন ক্রাইম জোনে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রায়ই ঘটছে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। গত এক বছরে এ রাস্তা থেকে বেশ কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক এবং গত রোববার প্যানেল মেয়রসহ সাতজন অপহৃত হয়েছেন।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের জনপদে পরিণত হওয়া নারায়ণগঞ্জে গত এক বছরে শতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০টি লাশ পাওয়া গেছে শীতলক্ষ্যা নদীর দীর্ঘতম তীরে বা তার আশপাশে। গত এক বছরে ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ঘটনা, কিশোর ত্বকীকে হত্যার পরও শীতলক্ষ্যার তীরেই ফেলে রাখা হয়। দুর্বৃত্তরা শীতলক্ষ্যার তীরটিকে লাশ ফেলে দেয়ার নিরাপদ স্থানে পরিণত করেছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, এসব স্পটে নিরাপত্তা টহল জোরদার না করার কারণে দিনের পর দিন অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে।
ভয়ঙ্কর পাঁচ কিলোমিটার:
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, একের পর এক ঘটনার কারণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডটি এখন এলাকাবাসীর কাছে আতঙ্কের রাজপথে পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাঁচ কিলোমিটার সড়কের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এখানে ঘটছে ছিনতাই, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড।
সম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত অপহরণ দুটিও ঘটেছে এই সড়কে। এরপরও এই সড়কটিতে প্রশাসনের নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই সড়কের পাশ থেকে গত এক বছরে ১০টি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
দেলপাগড়া এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ আসাদ আলী বাংলামেইলকে বলেন, ‘একেকটি ঘটনার কারণে চরম আতঙ্কে আছি। এই রাস্তা রাত ১১টার পর যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। রিকশাওলারাও এখন রাস্তায় থাকতে ভয় পাচ্ছে।’
গত ১৬ এপ্রিল ভূঁইঘর এলাকার ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের কাছে রাস্তা থেকে দিনে-দুপুরে তুলে নেয়া হয় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিককে। এ প্রসঙ্গে ওই ফিলিং স্টেশনের কর্মী আসাদ বলেন, ‘আমরা ঘটনাটা খেয়াল করি নাই। নিরব রাস্তায় ছিনতাই-টিনতাই হয়, তা শুনছি।’
গত ২৭ এপ্রিল লিংকরোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের কাছের রাস্তা থেকে সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। ওই এলাকার ভাঙারী ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ বলেন, ‘দিনের বেলা মাঝে-মধ্যে র্যাব-পুলিশের গাড়ি দেখি। তবে ওইদিন কে বা কারা এখানে আসছিল দেখি নাই।’
নিরাপত্তার ব্যপারে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক বাংলামেইলকে বলেন, ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের অপরাধের বিষয়ে আমরা অবগত আছি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বৃদ্ধিসহ সড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে।’
জানা যায়, গত ১৬ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি কড়ইতলা এলাকাতে হাত-পা বাঁধা হাদিস আলী নামে এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ এবং ১৪ এপ্রিল একই এলাকা থেকে অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ দু’টি লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ জানায়, অন্য কোনো স্থানে হয়তো তাদের হত্যার পর লাশ লিংক রোডের পাশে ফেলে দেয়া হয়।
গত ২৫ জানুয়ারি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভূঁইয়া পেট্রোল পাম্পের পাশের একটি ডোবা থেকে নিখোঁজের ছয়দিন পর পোশাকশ্রমিক তরিকুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা গেছে, গত এক বছরে এই রাস্তার পাশে থেকে আরো সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কাঁচপুর সেতুর ওপারে হাইওয়ে পুলিশের চেকপোস্ট থাকার কারণে ঢাকা থেকে অপহরণ এবং হত্যার পর অনেককে সাইনবোর্ড এলাকা দিয়ে লিংক রোডে নেয়া হয়। উদ্ধার করা অজ্ঞাত পরিচয় লাশগুলো বাইরে হত্যার পর এ এলাকায় এনে ফেলা হয়েছে।
লিংক রোডের ডেঞ্জার এলকা বলে পরিচিত খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে প্রায় সময়ই ঘটছে ছিনতাই। এখানে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে পুলিশের গুলিবিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে। এই রাস্তার মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনোটিরই রহস্য এখন পর্যন্ত উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এলাকাবাসী বলছেন, লিংক রোডে প্রবেশের দুটি পথে যদি পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকতো তাহলে এমন কোনো ঘটনা ঘটতো না।
এ ব্যাপারে ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আকতার হোসেন বাংলামেইলকে বলেন, ‘লিংক রোডে নিয়মিত পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট রয়েছে। কিন্তু অপরাধীরা পুলিশের গতিবিধি দেখেই অপরাধ করে। এ রোড থেকে অনেকবার ছিনতাইকারী ও দুর্বৃত্তদের অস্ত্রসহ আটকও করা হয়েছে।’
নারয়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ জেলায় রয়েছে বিরাট দৈর্ঘ্যের হাইওয়ে সড়ক। রাতের বেলায় এসব স্থান অনেক সময়ই অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে। যে কারণে সন্ত্রাসীরা অন্যত্র মার্ডার করে জেলার নিরিবিলি সড়কের পাশে এনে ফেলছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছি। লিংক রোডসহ হাইওয়েগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে।’
শীতলক্ষ্যায় মিলছে লাশ:
পুলিশ, হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রের তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জে গত এক বছরে শতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে অন্তত ৭০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সাম্প্রতিক ঘটনার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার পারেই বেশি লাশ উদ্ধার হচ্ছে। গত এক বছরে অন্তত ৩০টি লাশ উদ্ধার হয়েছে এ স্পট থেকে। এর মধ্যে গত বছরের ৮ মার্চ মেধাবী ছাত্র ত্বকীর লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যার তীরে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের স্থাপনায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে।
পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো উদঘাটন করতে সক্ষম হচ্ছে। স্কুলছাত্র সিয়াম, ইমন, সোয়েব হত্যার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেসব লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে তার সবগুলো নারায়ণগঞ্জের নাও হতে পারে। নদী দিয়ে ঘেরা জেলা হওয়ার কারণে খুনিরা খুন করে লাশ গুম করার জন্য নদী, পুকুর, ডোবা ইত্যাদি ব্যবহার করছে।’ বাংলামেইল২৪ডটকম