ছাইদুর রহমান নাঈম, নিজস্ব প্রতিবেদক, কিশোরগঞ্জ থেকে :
কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে পুরোদমে চলছে ধান কাটা৷ গানের ছন্দে ছন্দে মুখরিত এখন ফসলের অধিকাংশ মাঠ৷ শ্রমীকরা দলবেঁধে আনন্দ নিয়ে ধান কাট কাটছে৷
এখন পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকায় ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে কৃষকরা৷ একদিকে জমিতে মেশিন আরেকদিকে দলবেঁধে শ্রমীকদের ধান কাটার দৃশ্য এখন পুরো হাওরে৷ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জমির আশপাশে সড়কে পাইকারি ধান বিক্রি হচ্ছে৷ নতুন ধান মণ প্রতি ৮০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে৷ বস্তায় ভরে ধান নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন হাওরে জমির মালিকসহ পরিবারের সদস্যরা মিলেমিশে কাজ করছেন৷ লক্ষ্য একটাই তড়িঘড়ি ঘরে ধান তুলে ফেলা৷ এসময় অনেক কৃষকরা জানান, ১০-১২ দিন আবহাওয়া ভালো থাকলে হাওরের ধান ঘরে ওঠে যাবে৷ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় বোরো ধানা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে। এর মাঝে শুধু হাওরেই ১ লাখ ৪ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। যেখান থেকে উৎপাদিত চালের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। জানা যায়, জেলার ১৩টি উপজেলার সবক’টিতেই বোরো আবাদ হলেও ভূ-প্রাকৃতিক কারণে হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম এবং নিকলী উপজেলায় সর্বাধিক পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদিত হয়। প্রাকৃতিক কোনো দৈব-দুর্বিপাকে না পড়লে হাওরে প্রতি বছরই বাম্পার বোরো ফলনের সম্ভাবনা থাকে। তবে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনার মধ্যেও কৃষককে ফসল ঘরে না তোলা পর্যন্ত আতঙ্কে থাকতে হয়। আগাম বন্যা আর পাহাড়ি ঢলে প্রায় সময়েই মাঠভর্তি কৃষকের সোনালি ধান তলিয়ে যায়। এত ঝুঁকির মাঝেও এখন হাওরের মাঠে সরব পদচারণায় মুখর কৃষকের একটাই চিন্তা এক খণ্ড জমিও যেন কোনো অবস্থাতেই পতিত না থাকে।
গত বছর ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১২০০ টাকা প্রতি মণ। তবে এবার তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৪৪০ টাকা প্রতিমণ। কেজিপ্রতি যার দাম ৩৬ টাকা। সরকার এ বছর কৃষকদের কাছ থেকে ৩৯ টাকা কেজি দরে ধান ও ৪৮ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ করবে বলে জানা গেছে। নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামের কৃষক মোসলেহ উদ্দিন বলেন, খরচ ও ঋণ মেটাতে ধান ঘরে না তুলেই বিক্রি করে দিচ্ছি৷ ৮২০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে। যেখানে আমার এক মণ বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু করার কিছু নাই৷ ধার নিয়ে জমিতে খরচ করেছিলাম৷ এখন সেই টাকা দিতে হচ্ছে। একি এলাকার কৃষক আবুল খায়ের বলেন, ১২০ শতাংশ জমিতে ধান করে ভালো ফলন পেয়েছি৷ শ্রমীক দিয়ে ধান কাটলে খরচ পড়তো ২০ হাজার টাকা। মেশিন দিয়ে ধান কটছি ১২ হাজার টাকা দিয়ে। সবমিলিয়ে এবার লাভবান হলাম। হাওরের আরো বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, আবাদকৃত ধানের মধ্যে স্থানীয় জাত, উফশী এবং হাইব্রিড জাতের ধান রয়েছে। তবে এ বছর উফশী ও হাইব্রিড ধানের ব্যাপক আবাদ হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আগাম পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ফসলহানি রোধে এবার কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে উপজেলায় ২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ১২৯টি ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে এসব বাঁধের যথাযথ কাজ হয়েছে কিনা তা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে তদন্ত করার দাবি কৃষকদের৷ কারণ দায়সারা বাঁধের কারণে প্রায় সময় কৃষকের সর্বনাশ হয়ে থাকে৷ কৃষি শ্রমিকের সংকট কাটাতে হাওরে ২২০টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিন ধান কাটার কাজ করছে। এছাড়া প্রতিদিনই বাহিরের জেলা থেকে হার্ভেস্টার মেশিন আসছে।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাদিকুর রহমান বলেন, এবার জেলার ১৩ উপজেলায় বিভিন্ন জাতের ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমি। আর চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ টন। হাওরে এখন পুরোদমে বোরো ধান মাড়াই চলছে। পাকা ধান দ্রুত কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে ক্ষতি না করতে পারে। এবার ধানের বাম্পার ফলন পাবেন কৃষকেরা। শেষ পর্যন্ত যেন কৃষকদের মুখে হাসি থাকে, সেই প্রত্যাশা করেন তিনি।